কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু সেই মাছের অনেক প্রজাতিই একে একে হারিয়ে যায় খাবারের থালা থেকে। কেননা খাল-বিল-নদীতে স্বাদের মাছগুলো পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। কখনো সেসব মাছের দেখা মিললেও তা ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। কিন্তু সেই দুঃসময়টা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতির অনেকই ফিরেছে চাষির খামারে কিংবা খাল-বিল-নদী-নালায়। দেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হয়েছে মাছগুলো। হতাশার বিপরীতে এমন সাফল্য এসেছে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে।
প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা বিলুপ্তপ্রায় মত্স্য প্রজাতির ওপর গবেষণা করে এরই মধ্যে ২৩টি মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ-প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এসব প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে ব্যবহার এবং নদ-নদী ও বিলে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। এতে মাছগুলো অনেক পাওয়া যাচ্ছে এবং এর মূল্য সাধারণ ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। ওই ২৩টি মাছ হলো : ১. পাবদা, ২. গুলশা, ৩. টেংরা, ৪. শিং, ৫. মাগুর, ৬. গুজি আইড়, ৭. চিতল, ৮. ফলি, ৯. মহাশোল, ১০. বৈরালী, ১১. রাজপুঁটি, ১২. মেনি, ১৩. বালাচাটা, ১৪. গুতুম, ১৫. কুঁচিয়া, ১৬. ভাগনা, ১৭. খলিশা, ১৮. বাটা, ১৯. দেশি সরপুঁটি, ২০. কালিবাউশ, ২১. কই, ২২. গজার ও ২৩. গনিয়া।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মত্স্য সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের জিডিপিতে মত্স্য খাতের অবদান ৩.৬১ শতাংশ। এ খাতের একটি বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ। অবশ্য এরা নানা কারণে বিলুপ্তপ্রায়। প্রাচীনকাল থেকে এসব মাছের চাহিদা দেশের জনগোষ্ঠীর খাদ্যতালিকায় অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সহজলভ্য পুষ্টির উৎস হিসেবে বিবেচিত। মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে মিঠা পানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪টি বিলুপ্তপ্রায়। বিগত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অপরিমিত পানি ব্যবহার, কৃষিকাজে কীটনাশকের যথেচ্ছা ব্যবহার, পানিদূষণ এবং অতি আহরণের ফলে বা পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ ক্রমে অনেক হ্রাস পায়। অথচ প্রাকৃতিক জলাশয়ের অনেক ছোট প্রজাতির মাছ যেমন—মলা, ঢেলা, পুঁটি, কাচকি, বাইন, চান্দা ইত্যাদি আবহমানকাল থেকে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের পুষ্টির জোগান দিয়ে আসছিল।
মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩টি ছোট মাছ। দেশের মত্স্য উৎপাদনে ছোট মাছের অবদান ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনে বর্তমানে চার শতাধিক খামার কাজ করছে। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর ও কই ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। ইদানীং বাটা মাছের চাষ বেড়েছে।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, একসময় শুধু ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি গবেষণাকেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। বর্তমানে এ কেন্দ্র ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা হচ্ছে। ইনস্টিটিউট থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ ঢেলা, শাল বাইন, কাকিলা ও আঙ্গুস ভোল এবং উপকূলীয় কাওন মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে বিলুপ্তপ্রায় ও দেশীয় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা জোরদার করা হয়েছে এবং আমাদের বিলুপ্তপ্রায় সব মাছকে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ইনস্টিটিউট থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি মত্স্য অধিদপ্তর হতে নদ-নদী ও বিলে অভায়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রাপ্যতা বাজারে দিন দিন বাড়ছে। এটা বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য।’